পিরিয়ড, মেয়েদের বেড়ে ওঠার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এবং স্বাভাবিক একটা শারীরিক প্রক্রিয়া। তারপরও পিরিয়ড নিয়ে বহু ভুল ধারণা রয়েছে আমাদের সমাজে। আধুনিক যে যুগে আমরা পা রেখেছি, এখনো এসব ভুল ভাবনার শেকল আমাদেরকে ছাড়েনি। দুর্ভাগ্য এটাও, যে এ-বিষয়ে গ্রাম আর শহরের বাস্তবতায়ও পার্থক্য দেখা যায় না খুব একটা। পিরিয়ডের ব্যাপারে তোমাকে হয়তো আগে জানানোই হয়নি, যার ফলে প্রথম প্রথম তোমার ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। আর একই কারণে এই বিষয়ে মা-বোন, বাবা বা বাসার যে-কাউকে জিজ্ঞেস করতেও তোমার সংকোচ বা ইতস্তত বোধ হতেই পারে। তাই, পিরিয়ড নিয়ে খোলাখুলি আলোচনার সংস্কৃতি আর ঠিক জানাশোনার অভাবে এই বিষয়ে আমাদের পরিবারে ও সমাজে নানান কুসংস্কার থেকেই যাচ্ছে।
কী সেই ভুল ধারণাগুলো?
- খাবার সম্পর্কিত
পিরিয়ড চলাকালীন তোমাকে কখনো শুনতে হয়েছে “এটা খাওয়া যাবে না!” বা “রান্নাঘরে যাবে না!”, ইত্যাদি? তাহলে এই বিষয়ে একটা ঘটনা শোনো—
সাবিকুনের বয়স ১৪ বছর। সে গ্রামে থাকে, ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ালেখা করে। দুই বছর আগে তার প্রথম পিরিয়ড হয়েছিল। এই সময়টায় কী কী করা যাবে না, সেই বিষয়ে তার মা আর দাদী তাকে বেশ বড় একটা তালিকা দেন। যেমন: টক খাবার, দই, দুধ, মাছ-মাংস খাওয়া যাবে না; তাহলে নাকি রক্তপাত বেশি হবে! এমনকি, রান্নাঘরে যাওয়া কিংবা কারো খাবারে হাত দেওয়া যাবে না, এতে খাবার অশুদ্ধ হয়ে যাবে!
এই সবই তাদের ভুল ধারণা ছিল। এর ফল যা দাঁড়ালো, সাবিকুন একদিন স্কুলে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে পরে পরীক্ষায় ধরা পড়ে অপুষ্টি আর রক্তশূন্যতা। ডাক্তার তাকে প্রয়োজনীয় ঔষধ আর ভিটামিনের সাথে সাথে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ারও পরামর্শ দেন।
এভাবেই অনেক অভিভাবক এমন অযৌক্তিক কুসংস্কার আজও বিশ্বাস আর প্রচার করে আসছেন।
- কাজকর্ম সম্পর্কিত
- প্যাড কেনা নিয়ে লুকোচুরি
কখনো নিজে দোকানে প্যাড কিনতে গিয়েছো? সত্যি বলতে, স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার কথা ভাবলে দ্বিধায় পড়ে যাও, তাই না? মানুষ কীভাবে তাকাবে, দোকানদার কী বলবে বা ভাববে এসব চিন্তা করে আমরা অনেকেই নিজে প্যাড কিনতে যাই না। মায়েরা, কিংবা পরিবারের অন্য কেউ হয়তো স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে আনেন। দোকানদার সেটাকে অন্য পণ্য থেকে আলাদা করে প্যাকেটে মুড়িয়ে দেয়। কিন্তু স্যানিটারি ন্যাপকিনও তো আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যবহারের জন্য সাবান বা টয়লেট পেপারের মতোই আরেকটা পণ্য— লজ্জা আর অপ্রয়োজনীয় সংস্কার থেকে বের হয়ে আমাদের সবারই এই ব্যাপারটাকে এমন স্বাভাবিকভাবেই নেওয়া উচিত।
- কাপড়ে রক্তের দাগ
- প্যাড কেনা নিয়ে লুকোচুরি
প্রথম প্রথম পিরিয়ড হলে অসাবধানতাবশত কাপড়ে দাগ লেগে যেতেই পারে। ব্যাপারটা সম্পর্কে ঠিকঠাক জানা থাকার অভাবে অনেকেই সেদিকে তাকিয়ে থাকতে কিংবা লুকিয়ে হাসাহাসি করতে পারে, যেটার কোনো মানেই হয় না। তোমার সামনে কারো এমন দাগ লেগে থাকলে তুমি তাকে অন্য কারো সামনে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ার আগেই স্বাভাবিকভাবে বিষয়টা জানাতে পারো, কারণ এটা যেভাবে লজ্জা ব হাসাহাসির বিষয় না তেমনি এটা নিয়ে লুকোচুরিরও কিছু নেই।
- খেলাধুলা বা ব্যায়ামে বাধা
মা কিংবা বাসার অন্য বয়স্ক নারী সদস্যরা হয়তো পিরিয়ড চলার সময়টাতে খেলাধুলা করতে মানা করে থাকেন। এমনকি হালকা ব্যায়ামের উপরেও নিষেধ চলে আসে, যেখানে নিয়মিত ব্যায়াম আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পিরিয়ডের সময় হালকা ব্যায়াম রক্ত প্রবাহের মাত্রা ঠিক রাখতে এবং তলপেটের ব্যথা কমাতে ভালো ভূমিকা রাখে, এছাড়াও এই সময়ে হরমোন-জনিত কারণে যে অতিরিক্ত মুড সুইংয়ের সমস্যা দেখা দিতে পারে সেটাকেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
- পানিতে নামার বিষয়ে নিষেধ
পিরিয়ডের সময়ে নদী বা পুকুরে নামলে সেই পানি অশুদ্ধ হয়ে যাবে এমন একটা ভুল বিশ্বাসও অনেকের মধ্যে আছে, যার কোনো বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা বা যুক্তি নাই। এরকম দুশ্চিন্তারও তাই কোনো কারণ নাই।
- কারো সাথে পিরিয়ড নিয়ে কথা বলতে বারণ
প্রায় সব বয়সের অনেক অনেক নারীর মধ্যেই পিরিয়ড নিয়ে এই দ্বিধা কাজ করে। যেন এটা এমন কোনো বিষয়, যা নিয়ে বাইরে আলোচনা করা তো দূরের কথা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাসায় পরিবারের কাউকেও কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না! কিন্তু সব নারীরই হয় এমন একটা স্বাভাবিক শারীরিক ঘটনা নিয়ে অস্বাভাবিক নীরবতার দায় নেওয়ার কিছু নাই। পিরিয়ড নিয়ে সবার ঠিকঠাক জানা ও ধারণা থাকলে তাই এই বিষয়েও মেয়েদের পথচলাটা সহজ ও সুন্দর হয়ে উঠতে পারে।
পিরিয়ডের সময় কী মেনে চলবে আর কী এড়িয়ে চলবে?
নানান কুসংস্কার এবং ভুল ধারণা থাকা সত্ত্বেও পিরিয়ডে কিছু বিষয় আর কাজ সত্যিই দরকারি, আবার এমন কিছু কাজও আছে যেগুলো এড়িয়ে চলাই উচিত। নিজের নিরাপত্তা আর স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে এবার তাই সেগুলোও একসাথে দেখে নাও।
মেনে চলা উচিত | এড়িয়ে চললে ভালো |
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা | একই প্যাড বেশিক্ষণ ব্যবহার করা |
শাকসবজি ও ফলমূল বেশি করে খাওয়া | বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার (junk food) খাওয়া |
হালকা ব্যায়াম ও হাঁটাহাঁটি করা | ভারী কাজ করা |
দুধ ও ডিম-সহ সুষম খাবার গ্রহণ করা | ভাজাপোড়া ও তেল-মশলা জাতীয় খাবার খাওয়া |
বেশি বেশি পানি পান করা | ক্যাফিন-জাত খাবার বা পানীয়, যেমন কফি |
পর্যাপ্ত ঘুমানো | বেশি রাত জেগে থাকা |
জরুরি প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া | ব্যথা বা ফ্লো স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হলে তা নিয়ে অসচেতন থাকা |
সঠিক তথ্য জানা | অযথা ভয় ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগা |
নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখবে যেভাবে
পিরিয়ড নিয়ে নানান মিথ বা ভুল ধ্যানধারণার কারণে অনেক সময়েই মেয়েদের নানান সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। অনেক জায়গায় মনে করা হয় পিরিয়ড একটা অভিশাপ, আর এজন্য মেয়েদেরকে ওই সময় অশুদ্ধ ও নোংরা বলে মনে করা হয়, এমনকি সমাজের চোখে তাদের কোনো ধর্মীয় স্থানে যাওয়ার অধিকারও থাকে না তখন। আমাদের উচিত নিজের এবং আশপাশের পরিবারগুলো থেকে শুরু করে সমাজের সব স্তর থেকে এসব ভ্রান্ত ধারণার শেকড় তুলে ফেলা, এবং সকলকে বোঝানো যে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পিরিয়ড নিয়ে মেয়েদের সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য জানা থাকা এবং এটা নিয়ে স্বাভাবিকভাবে কথা হওয়া খুবই জরুরি।