পিরিয়ডকে বলা যায় বয়ঃসন্ধিতে আসা একটা মেয়ের জীবনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের বিশাল এক অধ্যায়। কিছু শারীরিক কিংবা মানসিক সমস্যা পিরিয়ডের পুরো সময় জুড়েই হতে পারে। যেমন: পেটব্যথা, বমি ভাব, ক্লান্তি বোধ করা ইত্যাদি।
কতদিন চলে এই পিরিয়ড?
একটি প্রশ্ন দুশ্চিন্তা হয়ে আমাদের মনে প্রায়ই উঁকি দেয়: “এই মাসে পিরিয়ড কবে শুরু হবে? আর কবেই বা শেষ হবে?”
সবেমাত্র বয়ঃসন্ধিতে পা রাখা মেয়েদের পিরিয়ড সাধারণত ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত চলতে পারে। কিন্তু বয়সের সাথে সাথে তা ৩ থেকে ৫ দিনে নেমে আসে। তবে এই চক্রের পরিবর্তন বিভিন্ন মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হতে পারে। আর এই মাসিক চক্র চলতে থাকে প্রায় ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত। ওরকম একটা বয়সের পরে পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যাওয়াটাকে বলে ‘মেনোপজ’ (menopause)।
Mood swing কী?
পিরিয়ড চলার অর্থ প্রতি মাসের ক’টা দিন এমন অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হওয়া, যেগুলো জীবনে আগে ছিল না এবং মাসের অন্য দিনগুলোতেও সেভাবে থাকে না। সেগুলোর মধ্যেই একটা বিষয় মুড সুইং (mood swing) বা কারণে-অকারণে ঘন ঘন মেজাজের পরিবর্তন— খুব স্পষ্ট বা নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই খুব বিরক্তির বোধ হওয়া, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে না পারা, ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে depression বা বিষণ্নতায় ভোগা ইত্যাদি। অনেক সময় না চাইতেও বন্ধু বা পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে খারাপ বা ভুল আচরণ করে ফেলা হয়। আবার অনেক সময় দেখা যায় সকালে মনটা বেশ ফুরফুরে থাকলেও কয়েক ঘণ্টা পরেই হঠাৎ মেজাজ খারাপ লাগছে।
কেন এই মুড সুইং হয়?
সাধারণত হরমোন লেভেলে হঠাৎ পরিবর্তনের কারণেই এই অনাকাঙ্ক্ষিত মুড সুইং ঘটে থাকে। আমাদের সবার শরীরে থাকা যেই বিভিন্ন প্রকারের জৈব-রাসায়নিক তরল বার্তাবাহক হিসেবে শরীরের সব কর্মকাণ্ডের মধ্যে সমন্বয় ঘটায়, সেগুলোকে হরমোন বলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শরীরে ‘dopamine’ ও ‘serotonin’ নামক দুই ধরনের হরমোনের মাত্রা কমে যাওয়ার ফলে এই লক্ষণগুলো দেখা যায়। এবং রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়াও মুড সুইং-এর অন্যতম কারণ হতে পারে।
কীভাবে তোমার মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিবে?
সবার প্রথমে মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করো। মন ভালো রাখার চেষ্টা করো, তোমার যেসব কাজ ভালো লাগে সেগুলোতে সময় কাটাও। তেমন কাজের মধ্যে থাকতে পারে গান শোনা, মুভি দেখা, বাসার মানুষজনের সাথে গল্প করা, হালকা ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করা, অথবা তোমার পছন্দের অন্য যেই কাজই করার সময় তোমার মন ভালো থাকে। এগুলোর পাশাপাশি তোমার ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে কিনা সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। ক্যাফিন-যুক্ত খাবার, বিশেষ করে কফি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবে। ক্যাফিনের প্রভাবে তলপেটে আর মাথায় ব্যথাও হতে পারে। তাছাড়া, ক্যাফিনের প্রভাব ঘুমেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখবে যেভাবে
পিরিয়ড এবং food craving
পিরিয়ডের সময় প্রায়ই বিভিন্ন জাঙ্ক ফুডের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যেতে দেখা যায়। বিশেষ করে আইসক্রিম, চকলেট, পিৎজা ও ফুচকা জাতীয় খাবার খাওয়ার ইচ্ছা বেশি হয়। খাবারগুলো খেতে মজার, সন্দেহ নেই। এবং খেলে হয়তো কিছুক্ষণ তোমার মন ভালো থাকবে, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদি ফল কিন্তু তেমন ভালো ন। পিরিয়ড চলাকালে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেল-সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া সবচেয়ে ভালো এবং দরকারি। তাই, নিয়মিত সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, দুধ ও ডিম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলো। এ-ধরনের স্বাস্থ্যকর অভ্যাস একবার তৈরি হলে তা মন ভালো রাখতেও সাহায্য করে।
পিরিয়ডের সময় ব্যথা বেশি হলে আদা চা খেয়ে দেখতে পারো। অনেক ক্ষেত্রেই এটি তাৎক্ষণিকভাবে ব্যথা কমিয়ে সুস্থ অনুভব করতে সাহায্য করে, তবে এটি সবার জন্য কার্যকর না-ও হতে পারে। আরেকটা জিনিস আছে, যেটা আমাদের সামনে থাকলেও মাঝে মাঝেই আমরা খেতে ভুলে যাই। কী সেটা? পানি! পিরিয়ডের সময় ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতার সম্ভাবনা থাকে, তাই এ-সময়টায় বেশি করে পানি খাও।
কোন্ খাবারগুলো এড়িয়ে চলবে?
মিষ্টি পছন্দ করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। কিন্তু অতিরিক্ত মিষ্টি বা লবণ জাতীয় খাবার আমাদের মুড সুইংয়ের কারণ হতে পারে। তাছাড়া, ঝাল-মশলা বা ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার menstrual flow অর্থাৎ মাসিকের সময় রক্তপাতের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। অনেক সময় এসব খাবার পেটব্যথারও কারণ হতে পারে। আর কফির বিষয়ে তো আগেও বলা হয়েছে। অতিরিক্ত ক্যাফিন তলপেটে ও মাথায় ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। তাই এসব খাবার পিরিয়ডের কয়েকটা দিন এড়িয়ে চলাই ভালো।
পিরিয়ডের সময় কি টক খাবার খাওয়া যাবে না?
‘Myth’ (মিথ) শব্দটি দিয়ে পুরোনো বিশ্বাস বা লোককথা বোঝানো হয়। পিরিয়ডের সময়ের খাদ্যাভ্যাস নিয়েও বেশ কিছু মিথ চালু আছে। সেগুলোর কোনো কোনোটা তোমার কানেও এসে থাকতেই পারে।
মাছ, মাংস, দই, টক খাবার (যেমন তেঁতুল) খাওয়া যাবে না, অথবা রান্নাঘরে ঢোকা বা কারো জন্য রান্না করা যাবে না, এমনকি অন্যের খাবারে হাত দিলে সেই খাবার অপবিত্র হয়ে যাবে— এসব কথার পিছনে কিন্তু কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই মোটেও। তবু বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের অনেক মানুষের মুখেই এসব কথা শোনা যায়, এই যুগেও। যেহেতু কথাগুলোর ভিত্তি নেই, তাই শুনলে মন খারাপ করো না। বরং, যারা বলছে তাদেরকে সম্ভব হলে মাথা ঠান্ডা রেখে বোঝানোর চেষ্টা করো।
দেখে নাও পিরিয়ড নিয়ে যত ভুল ধারণা
ঘরে বসে থাকবে, নাকি বাইরে বের হবে?
পিরিয়ডের সময় প্রায়ই ভাবতে হয়— “আমি কি বাসাতেই থাকবো? নাকি বাইরে যেতে পারবো?”
বের হবার সময় মাথায় ভিড় জমায় আরো অনেক প্রশ্ন— “প্যাড ঠিকঠাক আছে তো?” কিংবা “overflow বা বেশি রক্তপাত হলে কী হবে? জামায় দাগ লাগবে না তো?”
এই দিনগুলোতে বাড়িতে থাকার ইচ্ছা হলেও বা বাড়িতে থাকলে ভালো লাগবে মনে হলেও তা তো আর সব সময় সম্ভব হয় না। জরুরি কাজ থাকলে বের হওয়া যেতেই পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় মেনে চলা দরকার। যেমন সঠিক পিরিয়ড সামগ্রী বা প্যাড ব্যবহার করা, ব্যাগের মধ্যে বাড়তি প্যাড রাখা, বেশি করে পানি খাওয়া, স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হওয়া, ব্যথা বেড়ে গেলে কোথাও বসে বিশ্রাম নেওয়া, রোদে বেশি ঘোরাফেরা না করা ইত্যাদি।
এই দিনগুলোতে কি ব্যায়াম করা ভালো?
পিরিয়ডে কিছুটা স্বস্তিতে ভালো থাকার একটা খুব কাজের পদ্ধতি আছে, তা হলো নিয়মিত ব্যায়াম করা। পরিমিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা স্বাভাবিকভাবে সব বয়সের সব মানুষের জন্যই উপকারী। পিরিয়ডের সময়গুলোতে ব্যায়াম করার ইচ্ছা হয়তো একটু কম হবে। তবে হালকা হাঁটাহাঁটি বা কার্ডিও, যোগব্যায়াম এবং যেগুলো খুব কঠিন নয় তেমন ব্যায়াম তোমার জন্য খুবই ভালো হতে পারে। এই দিনগুলোতে আমাদের হয়তো খুব ক্লান্ত লাগে। কিন্তু ব্যায়াম শরীরের সুস্থতা ও মাংসপেশির ব্যথা কমানোর সাথে সাথে মনকে ভালো রাখতে সাহায্য করে, হরমোনের মাত্রাও ঠিক রাখে। তবে ভারী কাজ, যেমন ভারী কিছু তোলা অথবা দীর্ঘ সময় ধরে শারীরিক পরিশ্রম করার মতো কাজগুলো এড়িয়ে চলাই ভালো। এতে তলপেটে ব্যথা এবং রক্তপাত বেশি হতে পারে।
প্যাডের ব্যাপারে কী জানা দরকার?
পিরিয়ডের সময় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্যাড বা স্যানিটারি ন্যাপকিন। সাধারণত ৪-৮ ঘণ্টা পর্যন্ত তুমি একটি প্যাড ব্যবহার করতে পারবে।
পিরিয়ডের সময় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তোমার জন্য উপযুক্ত স্যানিটারি প্যাড, যা লিকেজ ছাড়াই পিরিয়ডের রক্ত ধরে রাখতে বা শোষণ (absorb) করে নিতে পারবে। এছাড়াও, নিশ্চিত করতে হবে প্যাডটা যেন আরামদায়ক হয় এবং যোনিতে চুলকানি বা জ্বালা সৃষ্টি করার মতো কোনো প্রকার সংক্রমণ (vaginal infection) না ঘটায়।
স্যানিটারি প্যাড বাছাই করার সময় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খেয়াল রাখা দরকার:
১. ভালো শোষণক্ষমতা
একটা ভালো স্যানিটারি প্যাড অল্প সময়ের মধ্যে ভালো পরিমাণে রক্ত শোষণ করতে পারে। শোষিত রক্ত যখন প্যাডের মধ্যের অংশেই আটকে দিতে পারে, তখন প্যাডে কোনোরকম চাপ পড়ার ঘটনায় (যেমন, বসার সময়) পাশ দিয়ে পিছনে ছড়িয়ে যাওয়ার (back flow) সম্ভাবনাও কমে। রক্ত ঠিকভাবে কেন্দ্রভাগে শোষিত হয়েছে কিনা, তা বুঝবার একটি উপায় হলো প্যাডের উপরের রক্তের রং খেয়াল করা। উজ্জ্বল বা তাজা রক্তের রং দেখলে বুঝতে হবে প্যাডটির শোষণক্ষমতা কম, যা back flow আটকাতে পারবে না। তাই, এর থেকে হতে পারে লিকেজ। কিন্তু রংটি যদি হালকা লাল বা আবছা লাল হয়, তাহলে এর অর্থ হলো রক্ত কার্যকরভাবে শোষিত হয়েছে।
২. প্যাডের দৈর্ঘ্য
পিরিয়ডের শুরুতে সাধারণত রক্তপাত বেশি হয়, তাই সেই রক্তকে দ্রুত ও কার্যকরভাবে শোষণ করতে পারে এমন একটি প্যাড বেছে নেওয়া দরকার হয়।
সময়ের হিসেবে রক্তের প্রবাহ অনুযায়ী স্যানিটারি প্যাডগুলোকে day এবং night ক্যাটেগোরিতে ভাগ করা হয়। ডে প্যাডগুলোর দৈর্ঘ্য ছোট (১৭০ মিঃমিঃ থেকে ২৫০ মিঃমিঃ পর্যন্ত) হয়ে থাকে এবং নাইট প্যাডগুলোর দৈর্ঘ্য হয় ৩৫০ মিঃমিঃ বা তার বেশি। মান ঠিক রেখে প্যাড যত লম্বা হয়, স্বাভাবিকভাবে তত বেশি রক্ত শোষণ করতে পারে। শুয়ে থাকার সময় পিছনের লিকেজ কার্যকরভাবে আটকানোর জন্য ভালো নাইট প্যাডে চওড়া hip guard থাকে।
৩. উপাদানগত আরাম
স্যানিটারি ন্যাপকিন তুলা, cotton বা net জাতীয় উপাদান দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে। প্রত্যেকের ত্বক আলাদা, তাই এভাবে নির্দিষ্ট উপকরণের সাথে আরামের মাত্রাও আলাদা। কারো হয়তো নরম তুলার প্যাড পছন্দ, আবার কারো নেটের top layer পছন্দ হতে পারে। কিন্তু উপাদানের ধরন বাতাস চলাচলকে প্রভাবিত করে।
যেই দিনগুলোতে রক্তপাত কম থাকে, তখন যোনিতে আর্দ্রতা বা ভেজা ভাবের মাত্রাও কম থাকে। কিন্তু উপাদান হিসেবে কোমল না হলে স্যানিটারি প্যাডের সাথে ত্বকের ক্রমাগত ঘষা লাগায় ত্বক লাল হয়ে যেতে দেখা যায়। একটি সাধারণ ভুল ধারণা হলো— পিরিয়ডের সময়ে যোনি ও আশপাশের অঞ্চলে (pubic area) ফুসকুড়ি বা rash হবেই। কিন্তু নরম ও আরামদায়ক স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে এই সমস্যাটি কমানো যেতে পারে।
বেছে নাও তোমার জন্য সঠিক স্যানিটারি ন্যাপকিনটি
ব্যবহার শেষে প্যাডটি কী করবে?
প্যাড ব্যবহার শেষে সেটিকে যেখানে-সেখানে না-ফেলে যত্ন সহকারে কাগজ বা কাপড়ে মুড়িয়ে ডাস্টবিনে বা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দেওয়া ভালো, এর ফলে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন থাকবে। পিরিয়ড হলো একেবারেই স্বাভাবিক একটি শারীরিক প্রক্রিয়া। নিজের স্বস্তি ও আরামকে কিছুটা প্রাধান্য দিলে পিরিয়ডের সময়টা আরেকটু সহজ হবে। মনে রাখবে, সঠিক প্যাড ব্যবহার করলে এবং সঠিক উপায় মেনে চলার মাধ্যমে মাসের এই নির্দিষ্ট দিনগুলোও তুমি ভালোভাবে পার করতে পারবে।