পিরিয়ড, নারীর জীবনে অত্যন্ত স্বাভাবিক কিন্তু অনেক বড় একটা ঘটনা। বয়ঃসন্ধিকালে শুরু হওয়া পিরিয়ড প্রত্যেক মেয়ের শরীরে ও মনে নিয়ে আসে অস্থায়ী এবং স্থায়ী অনেক পরিবর্তন। আপনার পরিবারে এবং কাজের জায়গায় আশেপাশে কেউ হয়তো যে-কোনো সময়েই পিরিয়ড নামের এই শারীরিক প্রক্রিয়াটার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের পিরিয়ড-কালীন পথচলা কিছুটা হলেও সহজ ও স্বাভাবিক রাখার জন্য আপনিও সহযোগিতা করতে পারেন – তা সে হোক সরাসরি কিংবা হোক কমবেশি পরোক্ষভাবে – যদি আপনিও এই বিষয়টাকে জানেন এবং কিছু বিষয় একটু সচেতনভাবে খেয়াল করেন।
পিরিয়ড ঠিক কী?
পিরিয়ড হওয়ার বয়সে স্বাভাবিকভাবে প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কয়েকটা দিন মেয়েদের যোনিপথ দিয়ে কিছু পরিমাণে রক্ত বের হয়, যা খুবই সাধারণ একটি শারীরিক প্রক্রিয়া। আর এই বিষয়টির নামই ‘পিরিয়ড’, যা আমাদের দেশে ‘রক্তস্রাব’ বা ‘মাসিক’ নামেও পরিচিত।
কেন এবং কীভাবে হয় এই পিরিয়ড? (Hyperlink of article 9)
গর্ভধারণের উপযোগী বয়সটাতে নারীর শরীর প্রতি মাসে গর্ভাবস্থার জন্য প্রস্তুত হয়। ডিম্বাশয় থেকে ‘ইস্ট্রোজেন’ (estrogen) আর ‘প্রোজেস্টেরন’ (progesterone) নামের দুই ধরনের হরমোন নিঃসরণ হয়ে থাকে। প্রায় এক মাস সময় নিয়ে এই হরমোনগুলো জরায়ুর ভিতরে একটি আস্তরণ তৈরি করে। এই আস্তরণ কয়েক স্তরে ভাগ হয়ে পুরো রক্তনালীর সাথে যোগসূত্র স্থাপন করে। সন্তান ধারণের জন্য স্বামী-স্ত্রীর মিলনের মাধ্যমে নিষিক্ত ডিমের সাথে সংযুক্ত হয়ে বিকাশ শুরু করতে তৈরি থাকে এই আস্তরণ। কিন্তু নিষিক্ত ডিম না থাকলে অর্থাৎ গর্ভাবস্থা না ঘটে থাকলে, সেই মাসে জরায়ু তার আস্তরণ ছিঁড়ে ফেলে। তাই সেখান থেকে কিছুটা রক্ত, কিছু টিস্যুর সাথে মিলে বেরিয়ে আসে যোনিপথ হয়ে।
কোন্ বয়সে পিরিয়ড শুরু হয়ে থাকে?
শারীরিক কিছু অবস্থার ওপর নির্ভর করে ১২ বছর বয়সের কিছু আগে কিংবা পরে প্রথম পিরিয়ড শুরু হয়৷ প্রথমদিকে হয়তো প্রতিমাসে নিয়মিত পিরিয়ড না-ও হতে পারে। তবে ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যে বেশিরভাগ মেয়ের ক্ষেত্রেই পিরিয়ড নিয়মিত হয়ে যেতে দেখা যায়।
প্রিয়জনের প্রথম পিরিয়ডে কী করবেন?
প্রথম পিরিয়ডের কয়েকদিন আগে থেকেই (সাধারণত ৫ দিন থেকে ২ সপ্তাহ পর্যন্ত আগে) মেয়ে কিছু পরিবর্তনের সম্মুখীন হবে, যার কিছু লক্ষণ কাছাকাছি থাকলে আপনিও খেয়াল করতে পারেন। যেমন— তলপেটে ব্যথা, ঘনঘন মেজাজ পালটে যাওয়া বা মুড সুইং, অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যাওয়া, মাথাব্যথা, ঘুমের সমস্যা, পিঠে ব্যথা ইত্যাদি। এগুলোকে premenstrual syndrome বা PMS বলে। তো, একজন সচেতন ও দায়িত্ববান পুরুষ হিসেবে আপনিও জেনে-বুঝে একটু তৈরি থাকলে পিরিয়ডের সময়টায় কাছের মানুষের অস্বস্তি অনেকটাই কমিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে পারবেন।
প্রথম পিরিয়ডের সময় বেশির ভাগ মেয়েই ভয় পেয়ে থাকে। তাই আগে থেকেই বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এবং সুন্দর গল্পের মাধ্যমে তার কাছে এই বিষয়টাকে আরো সহজ করে তুলতে পারেন, যাতে তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই পরিবর্তনের ব্যাপারে আগে থেকেই জেনে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা সম্ভব হয়। সম্পর্ক এবং নির্দিষ্টভাবে আপনাদের দু’জনের মধ্যকার বরাবরের আন্তরিকতা ও আস্থার জায়গা থেকে অবশ্যই এটা বুঝেই এই আলাপ শুরু করা উচিত হবে, যেন হঠাৎ এমন বিষয়ে কথা বলাটাই উলটো আরো বাড়তি অস্বস্তি বা নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি না করে।
পিরিয়ডের ফলে মেয়েদের শরীরে ও মনে পরিবর্তন আসে?
বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েরা বিভিন্ন পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়। বিশেষত পিরিয়ডের সময়টাতে প্রত্যেক মেয়েরই বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পিরিয়ডের প্রথম দুইদিন সাধারণত বেশি রক্তপাত হয়, সাথে দেখা যায় শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথাও থাকে। তখন ঘনঘন মুড সুইং হওয়া, মাথাব্যথা বা বিরক্ত বোধ হওয়া স্বাভাবিক। এরকম সময়ে প্রয়োজনে সেকের জন্য হট ওয়াটার ব্যাগটা এগিয়ে দেওয়া, পছন্দের খাবার রান্না করা বা নিয়ে আসা, সাধ্যের মধ্যে কিছু উপহার দেওয়ার মতো ছোট ছোট কাজও মুহূর্তেই আপনার প্রিয়জনের মন ভালো করে দিতে পারে। পিরিয়ড চলাকালে মেয়েরা সাধারণত মানসিকভাবেও অতি সংবেদনশীল বা স্পর্শকাতর থাকে, তাই আপনার বন্ধুত্বপূর্ণ সহমর্মিতা তার এই সময়টা তুলনামূলক সহজে কাটিয়ে উঠতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে।
কীভাবে তার যত্ন নিবেন?
পিরিয়ডের সময় আপনার কাছের মানুষের যা ভালো লাগে সেটা নিশ্চিত করা, তাকে মানসিকভাবে সহযোগিতা দেওয়া, স্বাস্থ্যকর খাবার আর নিয়মকানুনের ব্যাপারে সচেতন করা, তার পিরিয়ড সাইকেলের ব্যাপারে ধারণা রাখা এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া (যেমন— স্যানিটারি প্যাড, ট্যাম্পন বা প্রয়োজনীয় ওষুধ রেডি রাখা ইত্যাদি) এমন ছোট ছোট কাজগুলোর মাধ্যমেই তার পাশে থাকা সম্ভব। প্রত্যেক পুরুষের অনুভব করা এবং ভাবনায় রাখা উচিত, পিরিয়ডের সময় তার কাছের কোনো নারী কেমন শারীরিক ও মানসিক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দিন কাটান। এই সময়ে মানসিকভাবে পাশে থাকা এবং বন্ধুত্ব-মমত্বপূর্ণ আচরণ তিনি তো আশা করতেই পারেন আপনার কাছ থেকে। এই সময়ে ভালোবাসা ও মমতাই পিরিয়ড চলাকালীন বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারে।
তার পিরিয়ড সংক্রান্ত কী কী সমস্যা হতে পারে?
পিরিয়ডের সময়ে আপনার কাছের নারীর বিভিন্ন রকম সমস্যাই হতে পারে। সাধারণত ২১ থেকে ৩৫ দিনের সাইকেলের মধ্যেই পিরিয়ডের আসা-যাওয়া চলে। কখনো এই সময় পার হয়ে গেলেও পিরিয়ড না হওয়া, পিরিয়ড চলতে থাকা সময়ে অতিরিক্ত বমি ভাব, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, ৭ দিন পার হয়ে গেলেও পিরিয়ড থেকে যাওয়া, টানা কয়েক মাস পিরিয়ড না হওয়া, অতিরিক্ত ব্যথার মতো বিষয়গুলো অস্বাভাবিক এবং পিরিয়ডের ব্যাপারটাকে আরো বেশি কষ্টদায়ক করে তোলে। এমনকি endometriosis, pelvic inflammatory disease-সহ নানান অসুখও হয়ে থাকতে পারে। কাছের একজন দায়িত্বশীল পুরুষের তাই এসব বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান বা ধারণা এবং এমন সমস্যার লক্ষণ জানলে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো মাথায় রেখে চলা প্রয়োজন। প্রায়ই দেখা যায় পিরিয়ড চলাকালে ভারী কাজ করা, পরিচ্ছন্ন পরিবেশের অভাব, অথবা শারীরিক শ্রমের কাজ বেশি মাত্রায় করার ফলেও নারীদের শরীরে নানান সমস্যা হয়ে থাকে। তাই পিরিয়ডের সময়ে আপনার কাছের মানুষটাকে কোনো ভারী পরিশ্রমের কাজ থেকে অব্যাহতি দিতে পারলে এবং তার জন্য পরিচ্ছন্ন ও সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে আপনি তার শরীরের ওপর বাড়তি চাপ পড়ার সম্ভাবনা কমাতেও বেশ সহযোগিতা করতে পারবেন।
পিরিয়ড অস্বাভাবিক হওয়ার কারণ
কর্মক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কর্মস্থলে মেয়েদের পিরিয়ড চলাকালীন উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা এখনো মোটামুটি অনেক ক্ষেত্রেই অনেকটা অবাস্তব দাবির মতো শুনাতে পারে। অথচ কর্মস্থলে স্যানিটারি প্যাড ও ট্যাম্পন-সহ কিছু দরকারি সরঞ্জামের ব্যবস্থা রাখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। পিরিয়ড চলতে থাকা সময়ে প্রায়ই প্রবল ব্যথা-সহ শরীরের নানান অস্বাভাবিকতা বয়ে নিয়েও অনেক মেয়েকে কাজ করে যেতে হয়। তাই পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর রেস্ট রুম এবং অতিরিক্ত সমস্যা হলে ছুটির ব্যবস্থা রাখার মতো বিষয়গুলো বাস্তবায়নে পুরুষ সহকর্মীদেরই এগিয়ে আসা উচিত।
কোন্ বিষয়গুলো বদলানো দরকার?
আমাদের সমাজে এখনো পুরুষদের মাঝে মেয়েদের পিরিয়ড সম্পর্কিত নানান ভুল বিশ্বাস ও ধারণা চালু রয়েছে। পরিবারের পুরুষদের সামনে এসব বিষয়ে কথা না বলা, স্কুল-কলেজে পিরিয়ড বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলাকালে ছেলেদেরকে ক্লাস থেকে বাইরে রাখার মতো ব্যাপারগুলো এখনো দেখা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। অথচ এই সময়ে মেয়েদেরকে যে ভিন্ন রকম কষ্ট ও যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা বাড়ির পুরুষেরাও বুঝলে তবেই সম্ভব মেয়েদের ওপর ওই সময়টাতে না-বুঝে আরো বিভিন্ন রকম বোঝা চাপানোর সুযোগ ও সম্ভাবনা কমানো।
এই সমাজ যেহেতু পুরুষপ্রধান, এসব ক্ষেত্রে পুরুষদেরই বুঝে এগিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই। পরিবার এবং কাছের মানুষজনের মাঝে মন খুলে পিরিয়ড কিংবা পিরিয়ড-বিষয়ক সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারার মতো পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।
এখনো অনেক জায়গাতেই পিরিয়ডের সময়ে মেয়েদেরকে কাজ করতে দেওয়া হয় না, এমনকি অনেক কিছু স্পর্শ করতেও বারণ দেওয়া হয়— এসব কুসংস্কার-ভিত্তিক আচরণ দ্রুত বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। একেবারেই শরীরের সরাসরি সমস্যাগুলোর বাইরে আশপাশের কারণে উদ্ভূত অন্য ঝামেলা বা অস্বস্তিগুলোর হার ও সম্ভাবনাও এতে করে দিনে দিনে কমে যাবে বলে আশা করা যায়। দিনশেষে নারী এবং পুরুষ মিলে এক, কেউ কম কিংবা বেশি না।