মেয়েদের শারীরিক প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে পিরিয়ড অন্যতম। এই পিরিয়ড খুবই সাধারণ ও স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া হলেও কিছু অংশে এবং মাঝে মাঝে কমবেশি কষ্টেরও। এই সময়টায় তলপেট, পা, ঊরু, পিঠ বা মাথার মতো নানান জায়গায় ব্যথা হতে পারে, যা সাধারণত প্রথম দুইদিনে বেশি হয়ে থাকে। অনেক সময় অসহ্য পর্যায়েও চলে যেতে পারে এই ব্যথা।
কিন্তু এই ব্যথার কারণ কী?
- Prostaglandins
প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন মূলত হরমোন জাতীয় এক ধরনের লিপিড, যা জরায়ুর প্রাচীরে থাকে এবং সেখান থেকেই নিঃসৃত হয়। প্রদাহ (inflammation), ব্যথা বা জরায়ুর সংকোচনের মতো শারীরিক কিছু বিষয়ের জন্য দায়ী থাকে এরা। পিরিয়ডের প্রথম দিকে এদের পরিমাণ অনেক বেশি থাকায় ব্যথাও বেশি অনুভূত হয়।
- Estrogen ও progesterone
পিরিয়ডের চক্রটি নিয়ন্ত্রণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হরমোন এগুলো। আমাদের শরীরের অনেক প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল-ঘটিত প্রক্রিয়ায় সরাসরি প্রভাব ফেলে এই দুই ধরনের হরমোন। পিরিয়ড শুরু হলে ইস্ট্রোজেন লেভেল কমে যায় এবং প্রোজেস্টেরন-এর লেভেল উলটো বেড়ে যায়। এজন্যই তখন ব্যথা হয়, অনেক সময় মাথাব্যথা-সহ।
সবার শরীরে হরমোনের লেভেল একই থাকে না, বাড়া-কমাটাও সবার মধ্যে একইভাবে হয় না। তাই সবার ব্যথার পরিমাণও এক হয় না। দেখবে তোমার হয়তো খুব ব্যথা হচ্ছে, আবার পরিবারের বা বন্ধুদের মধ্যেই অন্য কারো হয়তো তেমন বেশি ব্যথা হয় না।
ব্যথা বেশি হওয়ার পিছনের কারণ নিচের যে-কোনো রকমই হতে পারে।
অতিরিক্ত রক্তপাত: নানান কারণে রক্তপাত বেশি হতে পারে। যেমন— দৌড়ঝাঁপ করলে অথবা ভারী ব্যায়াম বা ভারী কাজের ফলে অনেক সময় তলপেটে ব্যথা বাড়ে। এই কারণে মাঝে মাঝে মানসিক অস্থিরতারও সৃষ্টি হতে পারে।
অ্যাডিনোমায়োসিস (adenomyosis): জরায়ুর ভিতরে থাকা myometrium পেশির স্তরে endometrial গ্রন্থির বৃদ্ধির ফলে এই সমস্যা দেখা দেয়। এর ফলে জরায়ুর প্রাচীর পুরু ও আকৃতিতে বড় হয়ে যায়। এটা সাধারণত ৪০ থেকে ৫০ বছরের নারীদের মাঝে দেখা যায়।
এন্ডোমেট্রিওসিস (endometriosis): জরায়ুর সবচেয়ে ভিতরের স্তরে endometrium নামের পর্দাটি অস্বাভাবিকভাবে পুরু হয়ে গেলে এই সমস্যা দেখা যায়। সন্তান হয়নি এমন নারীরা এর ঝুঁকিতে একটু বেশি থাকেন।
ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড (uterine fibroids): জরায়ুর ভিতরে টিউমার বা ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড-এর কিছু কারণ থাকে। বেশি অল্প বয়সে পিরিয়ড শুরু হলে, বা শরীর অনেক ভারী হয়ে গেলে, কিংবা পরিবারে আগে কারো জরায়ু টিউমার থেকে থাকলে তোমারও এটা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে।
পিরিয়ডের ব্যথা অস্বাভাবিক হলে কী করবে
এই ব্যথা মোকাবেলা করবে কীভাবে?
অতিরিক্ত ব্যথা হলে কিছু বিষয়ে তোমার বিশেষ খেয়াল রাখা দরকার। যেমন—
- যথাযথ খাদ্যাভাস: পিরিয়ডের দিনগুলোতে নিজের যত্নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হলো সুষম খাবার খাওয়া। প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি এবং টাটকা ফলমূলের পাশাপাশি নিয়মিত মাছ, মাংস, ডিম ও দুধের মতো প্রোটিন-জাত খাবার খাবে। এই সুষম খাদ্য আমাদের শরীরের বিভিন্ন ঘাটতি পূরণ করতে, হরমোনের লেভেল ঠিক রাখতে এবং পিরিয়ডের সময় ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। সেই সাথে কফি, ভাজা-পোড়া খাবার এবং অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা ভালো।
- নিয়মিত ব্যায়াম: খোলা বাতাসে একটু হাঁটাহাটি বা হালকা এক্সারসাইজ সাধারণত পিরিয়ডের পেইন কমাতে বেশ কাজে আসে। ভারী কাজ বা ব্যায়ামের বদলে এই মৃদু এক্সারসাইজ অথবা যোগব্যায়াম করলে এটি তোমার হরমোন রেগুলেশনকে ঠিক রাখবে।
- জরুরি প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ: ব্যথা যদি খুব বেশি হয়, বা পিরিয়ডের স্থায়িত্ব বেশি হলে, অবশ্যই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত এবং তার পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজন হলে ওষুধ খাওয়া উচিত। কারণ, অস্বাভাবিক ব্যথা কোনো গুরুতর রোগের লক্ষণও হতে পারে।
পিরিয়ডে অফিস বা ক্লাস বাদ দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত?
পিরিয়ডে যদি তোমার বেশি কষ্ট হয়, অফিস বা স্কুল-কলেজ কামাই করতে পারো। বিশেষত তুমি যদি কেবল বয়ঃসন্ধিকালে পা দিয়ে থাকো এবং পিরিয়ডের সাথে তোমার অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন হয়ে থাকে, তবে এই সময়ে স্কুলে যাওয়াটা তোমার জন্য যথেষ্ট কষ্টদায়ক হতে পারে। অতিরিক্ত ব্লিডিংয়ের সাথে সাথে পেটব্যথা অথবা অন্যান্য সমস্যার কারণে বাড়ি থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বয়সের সাথে সাথে পিরিয়ডে ব্যথার পরিমাণ কিছুটা কমে আসে। সুতরাং তুমি যদি প্রাপ্তবয়স্ক হও এবং কোনো কাজে যোগ দিয়ে থাকো, সেটার জন্য যেতে অতটা সমস্যা হওয়ার কথা না। তবে ব্যথা বেশি থাকলে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় বিশ্রাম করা গেলে ভালো। কারণ, তোমার নিজের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা তো অন্য সবকিছুর উপরে।
প্যাড থেকে র্যাশের কারণ এবং এক্ষেত্রে করণীয় কী?
পিরিয়ডের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসটি হলো স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড ব্যবহার। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় এই প্যাডের কারণেই তোমার র্যাশ বা ফুসকুড়ি হচ্ছে। যত্ন না নিলে পরবর্তীতে তা ইনফেকশনে পরিণত হতে পারে। এগুলো কেন হয়, জানো?
সাধারণত একটি প্যাড দীর্ঘক্ষণ ব্যবহার করলে এবং প্যাড তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদান নিম্নমানের হয়ে থাকলে ত্বকে এই ধরনের র্যাশ বের হতে দেখা যায়। আবার অনেক প্যাডে সুগন্ধি ব্যবহার করা হয়, যাতে অনেকের অ্যালার্জি থাকে, তেমন হলেও র্যাশের সমস্যা হতে পারে। তাই, র্যাশ থেকে মুক্ত থাকতে কয়েকটা বিষয়ে খেয়াল রাখতে পারো—
- সুগন্ধিতে অ্যালার্জি থাকলে সুগন্ধযুক্ত প্যাড এড়িয়ে চলা
- সুতি কাপড়ের আন্ডারওয়্যার ব্যবহার করা
- হালকা গরম পানিতে গোসল করা
- বেশিক্ষণ ধরে একই প্যাড ব্যবহার না করা
পিরিয়ডের সময় যোনি ও আশপাশের যত্ন নিবে কীভাবে?
শরীরের এই অংশগুলো পিরিয়ড চলার সময়টাতে অতিরিক্ত sensitive বা সংবেদনশীল থাকে। তাই সঠিক যত্ন না নিলে নানারকম অসুখ হতে পারে, এমনকি সেগুলোর কোনোটা ক্যান্সারে পর্যন্ত রূপ নিতে পারে। এজন্য তোমার যা যা মেনে চলা প্রয়োজন—
- ভালো প্যাড ব্যবহার করা
- সময়মতো প্যাড পরিবর্তন করা
- সাবান ছাড়া হালকা গরম পানি দিয়ে যোনিপথ পরিষ্কার করা (কারণ, আমাদের নিয়মিত ব্যবহারের সাবানগুলো অনেক সময় ইনফেকশন এবং বিভিন্ন রোগ থেকে আমাদেরকে মুক্ত রাখা উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোকেও মেরে ফেলে।)
- যোনি এবং আশপাশের অঞ্চলকে ভেজা ভাব থেকে যতটা পারা যায় মুক্ত রাখা
কতক্ষণ পরপর প্যাড বদলানো প্রয়োজন?
বারবার বলা হয় একটা প্যাড বেশিক্ষণ ধরে পরে থাকা যাবে না। তাহলে তোমার প্রশ্ন আসতে পারে, ব্যবহৃত প্যাড কতক্ষণ পর পালটাবে!
এটা সাধারণত নির্ভর করে তোমার menstrual flow অর্থাৎ রক্তের প্রবাহের মাত্রার উপরে। মাত্রা বেশি থাকলে তাড়াতাড়িই পালটানোর দরকার হতে পারে। তবে এমনিতে চার ঘণ্টা পরপর পুরোনো প্যাড ফেলে নতুন প্যাড নেওয়া উচিত। তাই লম্বা সময় বাইরে থাকতে হবে জানলে অবশ্যই ব্যাগে আরো কিছু প্যাড রাখা ভালো।
প্যাড কীভাবে ফেলতে হবে?
প্যাড বা স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার শেষে সেটি কী করবে, তা নিয়েও প্রশ্ন থাকতে পারে তোমার মনে। নিজের স্বাস্থ্যসচেতনতার পাশাপাশি অন্যদের আর পরিবেশের প্রতিও তো কিছু দায়িত্ব আছে আমাদের। তাই একটা প্যাড কোথায় ফেলা হচ্ছে সে-বিষয়েও যত্নশীল হওয়া দরকার। বাসা হোক, অথবা স্কুল-কলেজ কি অফিস— বাথরুমে কিংবা খোলা জায়গায় প্যাড ফেলা ঠিক না। বাথরুমে ফেললে সেটি পাইপলাইনে আটকে যেতে পারে, আর বাইরে কোথাও ফেলে রাখলে সেটাও পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। ব্যবহারের পর প্যাড এজন্য ভালোভাবে টিস্যু বা কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলা উচিত।
ব্যস্ত দিনে heavy flow সামলাবে কীভাবে?
পিরিয়ডের প্রথম দুই-তিন দিনে সাধারণত menstrual flow বেশি হতে পারে। এই অবস্থায় তোমার সারাদিনের খুব ব্যস্ত রুটিন থাকলে প্যাড নিয়ে নানান দুশ্চিন্তা কাজ করতে পারে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লিকেজ হচ্ছে কিনা। বাইরে তোমার অনেক কাজ থাকলে বা তুমি সফরে থাকলে সেক্ষেত্রে বিশেষ প্যাড ব্যবহার করা উচিত, যেগুলো আকারে একটু বড় হয়ে থাকে এবং সেজন্যও আরো কিছু বেশি রক্ত শোষণ করে লিকেজ এড়াতে ভালো কাজ করে। এছাড়া, তোমার ব্যাগে বরাবরই বাড়তি কয়েকটা প্যাড রেখে দেওয়া ভালো, যেন প্রয়োজনে বদলে নিতে পারো।
বেছে নাও তোমার জন্য সঠিক স্যানিটারি ন্যাপকিনটি
প্যাডের পাশাপাশি আর কী সঙ্গে রাখা প্রয়োজন?
প্যাড ছাড়াও আরেকটা যেই বিষয় তোমার খেয়াল রাখা খুব জরুরি, তা হলো নিচের অন্তর্বাস (underwear/panty)। সিনথেটিক ফ্যাব্রিকের আন্ডারওয়্যার ব্যবহার না করে পাতলা ও সুতি কাপড়ের আন্ডারওয়্যার পরলে ভালো। এতে গরম কম লাগবে এবং ঘাম কম হবে, ফলে র্যাশ হওয়ার ঝুঁকিও কমে যাবে। আর, একই আন্ডারওয়্যারও দীর্ঘক্ষণ পরে থাকা ঠিক না। যেহেতু এটি ত্বকের সংস্পর্শে থাকে, সুতরাং ঘাম বা লিকেজ হয়ে থাকলে যত দ্রুত সম্ভব আন্ডারওয়্যারটিও পালটে ফেলা দরকার হয়। এজন্য ব্যাগে বাড়তি প্যাডের পাশাপাশি বাড়তি আন্ডারওয়্যারও রাখলে পিরিয়ডকালীন স্বাস্থ্যকর অভ্যাসে একইসাথে তুমি ত্বকের সমস্যাও এড়াতে পারবে।
পিরিয়ড হলো একেবারেই স্বাভাবিক একটি শারীরিক প্রক্রিয়া। নিজের স্বস্তি ও আরামকে কিছুটা প্রাধান্য দিলে পিরিয়ডের সময়টা আরেকটু সহজ হবে। মনে রাখবে, সঠিক প্যাড ব্যবহার করলে এবং সঠিক উপায় মেনে চলার মাধ্যমে মাসের এই নির্দিষ্ট দিনগুলোও তুমি ভালোভাবে পার করতে পারবে।