যারা পিরিয়ড হওয়ার মতো বয়সে আছেন এবং বর্তমানে গর্ভবতী না, এমন মেয়ে ও নারীদের সবারই স্বাভাবিকভাবে প্রতি মাসেই কয়েক দিনের জন্য পিরিয়ড হয়ে থাকে। কিন্তু পিরিয়ডে প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা কি একই? সবারই কি সমান রক্তপাত হয়, নাকি সবাই এই সময়টায় একই রকম বিষণ্ন থাকে? জানবো আমরা।
পিরিয়ড ঠিক কী?
পিরিয়ড হওয়ার বয়সে স্বাভাবিকভাবে প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কয়েকটা দিন মেয়েদের যোনিপথ দিয়ে কিছু পরিমাণে রক্ত বের হয়, যা খুবই সাধারণ একটি শারীরিক প্রক্রিয়া। আর এই বিষয়টির নামই ‘পিরিয়ড’, যা আমাদের দেশে ‘রক্তস্রাব’ বা ‘মাসিক’ নামেও পরিচিত।
কেন এবং কীভাবে হয় এই পিরিয়ড?
গর্ভধারণের উপযোগী বয়সটাতে নারীর শরীর প্রতি মাসে গর্ভাবস্থার জন্য প্রস্তুত হয়। ডিম্বাশয় থেকে ‘ইস্ট্রোজেন’ (estrogen) আর ‘প্রোজেস্টেরন’ (progesterone) নামের দুই ধরনের হরমোন নিঃসরণ হয়ে থাকে। প্রায় এক মাস সময় নিয়ে এই হরমোনগুলো জরায়ুর ভিতরে একটি আস্তরণ তৈরি করে। এই আস্তরণ কয়েক স্তরে ভাগ হয়ে পুরো রক্তনালীর সাথে যোগসূত্র স্থাপন করে। সন্তান ধারণের জন্য স্বামী-স্ত্রীর মিলনের মাধ্যমে নিষিক্ত ডিমের সাথে সংযুক্ত হয়ে বিকাশ শুরু করতে তৈরি থাকে এই আস্তরণ। কিন্তু নিষিক্ত ডিম না থাকলে অর্থাৎ গর্ভাবস্থা না ঘটে থাকলে, সেই মাসে জরায়ু তার আস্তরণ ছিঁড়ে ফেলে। তাই সেখান থেকে কিছুটা রক্ত, কিছু টিস্যুর সাথে মিলে বেরিয়ে আসে যোনিপথ হয়ে।
মাসের কোন্ দিনে পিরিয়ড হবে, কীভাবে বুঝবে?
পিরিয়ডের চক্র বা সাইকেলটি ব্যক্তিভেদে কমবেশি ভিন্ন হয়, সাধারণভাবে এটি ২৬ থেকে ৩২ দিনের মধ্যে হয়ে থাকে। Period cycle বলতে বুঝানো হচ্ছে তোমার একবার পিরিয়ড শুরু হওয়ার দিন থেকে আবার পরবর্তী পিরিয়ড শুরুর আগের দিন পর্যন্ত সময়টি কত দিনের। তুমি খেয়াল রাখলে তোমার নিজের ক্ষেত্রে এই সাইকেলটি নিজেই বুঝে নিতে পারবে। একেকবার পিরিয়ড কতদিন স্থায়ী হচ্ছে, তার সাথে সাথে একবার পিরিয়ড আসার কতদিন পর আরেকবার আসছে সেটিও লক্ষ করো। শুরুর স্বাভাবিক দিনটি মনে রাখতে তুমি এই তারিখটি ক্যালেন্ডারে চিহ্নিত করে কিংবা নোটবুকে লিখে রাখতে পারো। মোবাইল ফোনে বেশকিছু app-এর মাধ্যমেও আজকাল পিরিয়ড শুরু হওয়ার সময় অনুসরণ বা track করা যায়।
সবার পিরিয়ডের অভিজ্ঞতা কি এক?
পিরিয়ড নিয়ে সব মেয়ের অভিজ্ঞতা কখনই এক হয় না। হয়তো তোমার ক্ষেত্রে প্রতি মাসে তা ৪ দিন বা ৫ দিন স্থায়ী হচ্ছে, আরেক জনের হয়তো ৩ দিন। এটি বয়স, ওজন এমনকি দিনযাপনের বা নিয়মিত কাজের ধরনের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন রকম হয়। শারীরিক সুস্থতা বা হরমোন লেভেলের প্রভাবেও এই ভিন্নতা হয়। আবার পিরিয়ডের কারণে তলপেটে ব্যথা, মুড সুইং ইত্যাদিও এক এক জনের এক এক রকম মাত্রায় হতে পারে।
পিরিয়ডে রক্তের প্রবাহে ভিন্নতার কারণ কী?
- ওজনের হ্রাস-বৃদ্ধি: পিরিয়ডে রক্তপাতের পরিমাণ বা menstrual flow কম-বেশি হওয়ার পিছনে সম্ভাব্য একটা বড় কারণ হঠাৎ করে ওজন খুব বেড়ে বা কমে যাওয়া। ওজনে হঠাৎ এমন পরিবর্তন হলে শরীরের অন্য অনেক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি তোমার হরমোন রেগুলেশনেও পার্থক্য সৃষ্টি হয়। এর ফলে পিরিয়ডের ফ্লো-ও অন্য সময়ের বা স্বাভাবিকের চেয়ে কম অথবা বেশি হতে পারে।
- বিষণ্নতা: দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত depression-এ বা মানসিক চাপে থাকার ফলেও হরমোন লেভেল ওঠানামা করতে পারে, যা পিরিয়ডের সাইকেল-টাকে নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি ফ্লো বেড়ে কিংবা কমে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
- রক্তস্বল্পতা: আরেকটা বিশেষ কারণ হলো শরীরে রক্তস্বল্পতা বা anemia. শরীরে লোহিত রক্তকণিকার পরিমাণ কমে গেলে এটা হয়। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়েই মেন্সট্রুয়াল ফ্লো কম অথবা পিরিয়ড দেরিতে হতে দেখা যায়।
পিরিয়ডে ব্যথা কম-বেশি কেন হয়?
পিরিয়ডে সবচেয়ে কষ্টদায়ক বিষয় হলো তলপেটে ব্যথা। তলপেট সহ ঊরু, পা ও পিঠেও ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে অনেক সময়। এতে স্কুল, কলেজ বা অফিস যাওয়াও সম্ভব হয় না।
এই ব্যথা কারো কারো বেশি হওয়ার পিছনের কারণ নিচের যে-কোনো রকমই হতে পারে।
অতিরিক্ত রক্তপাত: নানান কারণে রক্তপাত বেশি হতে পারে। যেমন— দৌড়ঝাঁপ করলে অথবা ভারী ব্যায়াম বা ভারী কাজের ফলে অনেক সময় তলপেটে ব্যথা বাড়ে। এই কারণে মাঝে মাঝে মানসিক অস্থিরতারও সৃষ্টি হতে পারে।
অ্যাডিনোমায়োসিস (adenomyosis): জরায়ুর ভিতরে থাকা myometrium পেশির স্তরে endometrial গ্রন্থির বৃদ্ধির ফলে এই সমস্যা দেখা দেয়। এর ফলে জরায়ুর প্রাচীর পুরু ও আকৃতিতে বড় হয়ে যায়। এটা সাধারণত ৪০ থেকে ৫০ বছরের নারীদের মাঝে দেখা যায়।
এন্ডোমেট্রিওসিস (endometriosis): জরায়ুর সবচেয়ে ভিতরের স্তরে endometrium নামের পর্দাটি অস্বাভাবিকভাবে পুরু হয়ে গেলে এই সমস্যা দেখা যায়। সন্তান হয়নি এমন নারীরা এর ঝুঁকিতে একটু বেশি থাকেন।
ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড (uterine fibroids): জরায়ুর ভিতরে টিউমার বা ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড-এর কিছু কারণ থাকে। বেশি অল্প বয়সে পিরিয়ড শুরু হলে, বা শরীর অনেক ভারী হয়ে গেলে, কিংবা পরিবারে আগে কারো জরায়ু টিউমার থেকে থাকলে তোমারও এটা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে।
পিরিয়ড অনিয়মিত হওয়ার বিষয়টা কতটা স্বাভাবিক, এবং কেন হতে পারে?
গর্ভাবস্থায় মেয়েদের পিরিয়ড বন্ধ থাকে। আর, তোমার ওজন হঠাৎ করে খুব বেড়ে বা কমে গেলে তার প্রভাব পিরিয়ড চক্রের উপরেও পড়তে পারে। আবার দীর্ঘদিন মানসিক দুশ্চিন্তায় থাকলে, শারীরিক শ্রম বেশি হলে, বা ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোন ভারসাম্যে না থাকলে তোমার পিরিয়ড নির্ধারিত সময়ের থেকে বেশ দেরি করে আসতে পারে। এছাড়াও বেশি ক্যাফিন-যুক্ত খাবার খাওয়া, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা অথবা অপরিচ্ছন্ন থাকার ফলেও পিরিয়ড অনিয়মিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি কোনো জটিল রোগ বা ইনফেকশনের ক্ষেত্রেও, যেমন জরায়ু টিউমারে আক্রান্ত হলেও, কয়েক মাস পর্যন্ত পিরিয়ড বন্ধ থাকতে পারে।
পিরিয়ডে অনিয়মের কোন্ কারণগুলো আশঙ্কাজনক?
পিরিয়ড অনিয়মিত হওয়ার কিছু কারণ অবশ্য তুলনামূলকভাবে জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন—
- থাইরয়েডের সমস্যা: থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন আমাদের দেহের বিপাকে ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। থাইরয়েডে কোনো সমস্যা হলেও পিরিয়ড দেরিতে হতে পারে।
- ক্রনিক রোগ: ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি রোগ বলতে আমরা সাধারণত সে রোগগুলোকে বুঝি, যেগুলো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া-জনিত না বরং শরীরের নানান প্রক্রিয়ার কারণেই দীর্ঘদিনের জন্য বাসা বাঁধে। যেমন ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা ইত্যাদি। তোমার পিরিয়ড চক্রে এগুলোও প্রভাব ফেলতে পারে।
- টিউমার: পিরিয়ড দেরিতে হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হতে পারে জরায়ুতে টিউমার। এর জন্য তলপেটে ব্যথা, অতিরিক্ত রক্তপাত কিংবা পিরিয়ড কয়েক মাস পর্যন্ত বন্ধ থাকার মতো লক্ষণ দেখা যায়।
তাই, পিরিয়ড সাইকেলে কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন বা অনিয়মিত ভাব বুঝতে পারলে তোমার উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের কাছে যাওয়া এবং তার পরামর্শে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করিয়ে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া।
পিরিয়ড-কালীন টুকিটাকি সমস্যার ঘরোয়া প্রতিকার
পিরিয়ডের কারণে যে শারীরিক সমস্যাগুলোর মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হয়, তার বেশ কিছুই সহজ ঘরোয়া কোনো পদ্ধতিতে মোটামুটি কমিয়ে আনা যায়। যেমন:
- তলপেটের ব্যথা কমাতে হট ওয়াটার ব্যাগের সাহায্যে সেক দেওয়া
- স্বাভাবিক পিরিয়ডে শরীর ও মনকে কিছুটা চাঙ্গা রাখতে যোগব্যায়াম করা
- রক্তপাতের মাত্রা স্বাভাবিকের দিকে রাখতে নিয়মিত সবুজ শাকসবজি এবং ফলমূল খাওয়া
- রক্তের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি ব্যথাও অনেকটা কম রাখার জন্য ক্যাফিন গ্রহণ যতটা পারা যায় কমিয়ে আদা-চা খাওয়া
কখন ডাক্তারের সাথে কথা বলবে?
উপরের ঘরোয়া সমাধানগুলো অনেক সময় তোমার ক্ষেত্রে দ্রুত বা যথেষ্ট ভালো ফল না-ও দিতে পারে। তোমার সমস্যা বাড়তে থাকলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি। কোনো গুরুতর রোগের লক্ষণ থেকে থাকলে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও চিকিৎসার মাধ্যমে তার নিরাময় করা উচিত হবে। তাই, বেশি দেরি না করে ডাক্তারের কাছে যাও, যদি—
- পরপর প্রতি মাসেই তোমার আগের হিসাবের থেকে বেশ আগে বা পরে পিরিয়ড শুরু হয়, বা
- পিরিয়ড খুব বেশি অনিয়মিত হয় (অর্থাৎ কোনো কোনো মাসে এমনকি পিরিয়ড না হয়), বা
- পিরিয়ড ৭ দিনের বেশি স্থায়ী হয়, বা
- রক্তের প্রবাহ বেড়ে যায়, বা
- পিরিয়ডের রক্তের রং অস্বাভাবিক হয়, বা
- রক্তের সাথে অতিরিক্ত পরিমাণে টিস্যু দেখা যায়, অর্থাৎ রক্তটা বেশি ঘন হয়।
পিরিয়ড একটা শারীরিক প্রক্রিয়া এবং স্বাভাবিভাবে সব মেয়েরই এর সম্মুখীন হতে হয়। তাই, ভয় না পেয়ে সঠিক তথ্য জেনে সঠিক নিয়ম ও উপায় মেনে চলা দরকার। এই বিশেষ দিনগুলোতে নিজের প্রতি মনোযোগী ও যত্নশীল থাকার মাধ্যমে তুমি পিরিয়ড তুলনামূলক ভালোভাবে কাটাতে পারবে। তবে বড় অস্বাভাবিকতার ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিবে, যেন নিজের অবহেলাই পরবর্তীতে আরো বড় ধরনের শারীরিক দুর্যোগের জন্য দায়ী না হয়।